শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনের আয়াত
শবে বরাত (লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান) ইসলামি সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেক মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, এই রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন এবং তাদের তাকদির নির্ধারণ করেন।তবে কুরআনে সরাসরি শবে বরাতের উল্লেখ নেই, এবং হাদিসের দলিলগুলো নিয়েও বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।
১. শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি
অনেকে দাবি করেন যে, সুরা আদ-দুখান (৪৪:৩-৪) এ উল্লেখিত “লাইলাতুম মুবারাকা” (বরকতময় রাত) শবে বরাতকে বোঝায়। আয়াতগুলো হলোঃ
> إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ (٣) فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ (٤)
বাংলা অর্থঃ
“নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে এটি (কুরআন) নাজিল করেছি। নিঃসন্দেহে আমি সতর্ককারী। সে রাতে সকল প্রজ্ঞাময় বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
আরও পড়ুনঃ শবে বরাতের নামাজের নিয়ম ও নিয়ত
তবে, অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, এখানে “লাইলাতুম মুবারাকা” বলতে লাইলাতুল কদর বোঝানো হয়েছে, যা রমজান মাসে হয়। কারণ, কুরআনের অন্যত্র স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ
> شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ
“রমজান মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে।” (সুরা আল-বাকারা: ১৮৫)।
অতএব, কুরআনের আলোকে শবে বরাতের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না।
২. শবে বরাত সম্পর্কে হাদিসের আলোচনা
শবে বরাতের ফজিলত নিয়ে কিছু হাদিস পাওয়া যায়, তবে অনেক হাদিসকে দুর্বল (দাইফ) বা জাল (মাওদু) বলা হয়েছে। নিচে কিছু হাদিস উল্লেখ করা হলোঃ
সহিহ ও গ্রহণযোগ্য হাদিস
১. আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের ১৫তম রাতে ক্ষমার দরজা খুলে দেন
> হাদিস
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
“যখন শাবান মাসের মধ্যরাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের ক্ষমা করে দেন, তবে মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া।” (সূত্র: ইবনু মাজাহ, হাদিস: ১৩৯০; সহিহ করেছেন শাইখ আলবানী)
➡ এই হাদিসটি সহিহ বলে গণ্য হয়েছে এবং অনেক স্কলার একে গ্রহণ করেছেন।
আরও পড়ুনঃ শবে বরাত নামাজ কিভাবে পড়তে হয়
❌ দুর্বল বা জাল হাদিস
১. শবে বরাতের রাতে বিশেষ নামাজ পড়ার ফজিলত
অনেকেই বলেন যে, শবে বরাতে ১০০ রাকাত বা ১৪ রাকাত নামাজ পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে বর্ণিত হাদিসগুলো দুর্বল (দাইফ) বা জাল (মাওদু) হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
> ইমাম ইবনু জাওযী, ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি, ও শায়খ আলবানী বলেছেনঃ
“শবে বরাতের রাতে বিশেষ কোনো নামাজের ফজিলত সংক্রান্ত সব হাদিস জাল বা দুর্বল।”
➡ তাই শবে বরাতের রাতে ১০০ রাকাত বা ১৪ রাকাত নামাজের বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো হাদিস নেই।
৩. শবে বরাত সম্পর্কে সালাফদের মতামত
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) বলেছেনঃ
> “শবে বরাতের রাত ফজিলতপূর্ণ, তবে এ রাতে বিশেষ নামাজ পড়া, জিকির করা, আলাদাভাবে রোযা রাখা ইত্যাদির দলিল সহিহ নয়।” (মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া, ২৩/১৩১)।
ইমাম নববী (রহ.) বলেছেনঃ
> “শবে বরাতকে ইবাদতের বিশেষ রাত হিসেবে নির্ধারণ করার দলিল সহিহ নয়।”
আরও পড়ুনঃ ক্যাপচা লিখে আয়
ইবনু কাসির (রহ.) বলেছেনঃ
> “কোনো নির্দিষ্ট দলিল ছাড়া শবে বরাতকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা বিদআত।” (তাফসির ইবনু কাসির)
➡ অর্থাৎ, সালাফদের দৃষ্টিতে শবে বরাতের ফজিলত স্বীকৃত হলেও, এ রাতে বিশেষ কোনো আমল করার প্রমাণ নেই।
৪. শবে বরাতের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়
✅ যা করা যায়
- আল্লাহর কাছে গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা
- সাধারণ নফল ইবাদত ও কুরআন তিলাওয়াত করা
- কবর জিয়ারত করা (সুনানে ইবনু মাজাহ, ১৩৮৯)
❌ যা করা উচিত নয়
- বিশেষ নামাজ, রোযা বা জিকির নির্ধারণ করা
- শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান করা
- হালুয়া-রুটির আয়োজন করা (এর কোনো শরঈ ভিত্তি নেই)
আরও পড়ুনঃ কুইজ খেলে টাকা ইনকাম app
শেষ কথা
- শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনে কোনো সরাসরি প্রমাণ নেই।
- শবে বরাতের ফজিলত সংক্রান্ত কিছু সহিহ হাদিস রয়েছে, তবে বিশেষ ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই।
- এ রাতে ইবাদত করা নিষিদ্ধ নয়, তবে বিশেষ নামাজ, রোযা বা মিলাদ আয়োজন করা বিদআত হিসেবে গণ্য হতে পারে।
- এ রাতে গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং সাধারণ নফল ইবাদত করা উত্তম।
আর তাই, শবে বরাত উদযাপনের ক্ষেত্রে কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করাই শ্রেয়।