রমজানের ফাজায়েল ও মাসায়েল
রমজান হলো ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠতম মাস, যা তাকওয়া অর্জন, আত্মশুদ্ধি এবং গুনাহ মাফের বিশেষ সুযোগ এনে দেয়। এটি শুধু উপবাস থাকার মাস নয়। বরং আত্মসংযম, ধৈর্য, ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম।
কুরআন মাজিদে রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “রমজান মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথনির্দেশ এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)।রমজানের ফাজায়েল (ফজিলত) সম্পর্কে বহু হাদিস ও আয়াত রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, এ মাসে নফল ইবাদতের সওয়াব ফরজ ইবাদতের সমান এবং ফরজ ইবাদতের সওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি পায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (সহিহ বুখারি: ৩৮)। রমজানের রোজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু বিধান ও মাসায়েল, যা প্রত্যেক মুসলমানের জানা প্রয়োজন।
রোজা ভঙ্গের কারণ, কাজা ও কাফফারা, তারাবিহ নামাজ, ইতিকাফ, সাহরি ও ইফতারের নিয়মসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এসব বিধান যথাযথভাবে মানলেই রমজানের পূর্ণ ফজিলত অর্জন করা সম্ভব।
এই কিতাবে রমজানের ফাজায়েল ও মাসায়েল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, যাতে মুসলিম উম্মাহ এ মাসের বরকত ও রহমত থেকে পরিপূর্ণভাবে উপকৃত হতে পারে। আজকের আর্টিকেলে রমজানের ফাজায়েল ও মাসায়েল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
রমজানের ফাজায়েল ও মাসায়েল?
রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক মহিমান্বিত মাস। এটি তাকওয়া অর্জনের মাস, আত্মশুদ্ধির সময় এবং গুনাহ মাফের সুবর্ণ সুযোগ। এই মাসে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য নেয়ামত দান করেন এবং বান্দাদের প্রতি তাঁর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়।
আরও পড়ুনঃ রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে হাদিস
রমজানের ফাজায়েল (ফজিলত)?
১. রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনঃ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)
২. রোজার সওয়াব ও গুনাহ মাফের সুযোগ
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (সহিহ বুখারি: ৩৮, সহিহ মুসলিম: ৭৬০)।
৩. জান্নাতে রোজাদারদের জন্য বিশেষ দরজা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ “জান্নাতে ‘রাইয়্যান’ নামে একটি দরজা আছে, যেখানে দিয়ে কেবল রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। তাদের প্রবেশের পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অন্য কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহিহ বুখারি: ১৮৯৬, সহিহ মুসলিম: ১১৫২)।
৪. রোজাদারের দোয়া কবুল হয়
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ “তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফেরত দেওয়া হয় নাঃ (১) ন্যায়পরায়ণ শাসকের, (২) রোজাদারের, যখন সে ইফতার করে, (৩) মজলুমের দোয়া।” (তিরমিজি: ২৫২৫)।
৫. লাইলাতুল কদরের ফজিলত
আল্লাহ বলেনঃ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
“লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।” (সূরা আল-কদর: ৩)।
রমজানের মাসায়েল (বিধান ও নিয়ম)
রমজানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও মাসায়েল জানা প্রয়োজন, যাতে আমরা শুদ্ধভাবে রোজা রাখতে পারি।
১. রোজা ফরজ হওয়ার শর্ত
- মুসলমান হতে হবে।
- প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে।
- সুস্থ থাকতে হবে।
- মহিলা হলে হায়েজ ও নিফাসমুক্ত থাকতে হবে।
২. রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ
- ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বা পানি পান করা।
- স্বামী-স্ত্রীর মিলন করা।
- ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা।
- মাসেহারা (ঔষধি ধোঁয়া বা ধূমপান গ্রহণ করা)।
৩. রোজা ভঙ্গ না হলেও কাফফারা দিতে হয় না যেসব কারণে
- অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়া।
- ভুলবশত খেয়ে ফেলা বা পান করা।
- ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হওয়া।
- ইনজেকশন বা স্যালাইন নেওয়া (যদি পুষ্টির জন্য না হয়)।
৪. রোজার কাফফারা ও কাজা
ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভেঙে ফেললে পরবর্তী সময়ে তার কাজা করতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে ৬০ দিন রোজা রাখতে হবে অথবা ৬০ জন গরিবকে খাওয়াতে হবে। অসুস্থতার কারণে রোজা ভাঙলে, সুস্থ হওয়ার পর শুধু কাজা করতে হবে।
৫. তারাবিহ নামাজের বিধান
- তারাবিহ ২০ রাকাত সুন্নতে মুআক্কাদাহ (বেশি নিশ্চিত সুন্নত)।
- একা বা জামাতে পড়া যায়।
- কুরআন খতম করা সুন্নত, তবে সম্ভব না হলে ছোট সূরাও পড়া যেতে পারে।
৬. ইতিকাফের নিয়ম
- রমজানের শেষ দশকে মসজিদে বসে ইবাদতে মগ্ন থাকা সুন্নত।
- মহিলারা বাড়িতে নির্দিষ্ট জায়গায় ইতিকাফ করতে পারেন।
- ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া জায়েজ নয়, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া।
আরও পড়ুনঃ সাওমের প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হয়
৭. সাহরি ও ইফতারের নিয়ম
- সাহরি খাওয়া সুন্নত, যতক্ষণ সম্ভব দেরি করা উত্তম।
- ইফতার দ্রুত করা উত্তম, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করা উচিত।
ইফতার শুরু করতে এই দোয়া পড়া উত্তমঃ
اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ
“হে আল্লাহ! তোমার জন্য আমি রোজা রেখেছি এবং তোমার দেওয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করছি।” (আবু দাউদ: ২৩৫৮)
শেষ কথা
রমজান মুসলমানদের জন্য এক অফুরন্ত নিয়ামতের মাস। এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও দান-সদকা করা উচিত।
রোজার ফজিলত অর্জন করতে হলে তার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানা এবং শুদ্ধভাবে পালন করা জরুরি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের ফজিলত অর্জন এবং সঠিকভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন!