আজানের জবাব ও দোয়া
ইসলামে আজান একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যা প্রতিদিন পাঁচবার মুসলমানদের নামাজের দিকে আহ্বান করে। আজান শুধু নামাজের ঘোষণা নয়। ইহা এক মহান তাসবিহ, যেখানে আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর একত্ববাদ প্রকাশিত হয়।
নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের শিখিয়েছেন, আজানের জবাব দেওয়া সুন্নত এবং এটি একটি সওয়াবের কাজ। আজানের পর দোয়া করারও বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে।রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আজানের পর দোয়া পড়বে, সে কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ লাভ করবে।” (সহিহ বুখারি)। আজানের দোয়া মূলত নবিজির জন্য দোয়া ও প্রশংসা, যা এক মুসলিমের জন্য পরকালের মুক্তির বড় মাধ্যম হতে পারে।
আজানের জবাব দেওয়া এবং দোয়া পড়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি এবং আমাদের গুনাহসমূহ মাফ হওয়ার সুযোগ পাই। তাই প্রতিটি মুসলিমের উচিত, নিয়ম অনুযায়ী আজানের জবাব দেওয়া এবং দোয়া পড়ে আল্লাহর রহমত কামনা করা।
আজানের জবাব ও দোয়া?
আযান শোনার সময় মুয়াযযিন যা বলেন, শ্রোতাকেও সাধারণত তা-ই বলা সুন্নত। তবে দুইটি বাক্যে ব্যতিক্রম রয়েছে। নিচে আযানের প্রতিটি বাক্যের জবাব উল্লেখ করা হলোঃ
১. আল্লা-হু আকবর
উত্তরঃ আল্লা-হু আকবর (৪ বার)
২. আশহাদু-আল্ লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ
উত্তরঃ আশহাদু-আল্ লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ (২ বার)
৩. আশহাদু-আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ
উত্তরঃ আশহাদু-আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ (২ বার)
৪. হাইয়া আলাস সালা
উত্তরঃ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ্ (২ বার)
৫. হাইয়া আলাল ফালা
উত্তরঃ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ্ (২ বার)
৬. আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম
উত্তরঃ সাদাকতা ও বারারতা (২ বার)
(শুধুমাত্র ফযরের আযানের জন্য)
৭. আল্লা-হু আকবর
উত্তরঃ আল্লা-হু আকবার (২ বার)
৮. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
উত্তরঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (১ বার)
অর্থঃ
১. আল্লাহ সর্বশক্তিমান
উত্তরঃ আল্লাহ সর্বশক্তিমান (৪ বার)
২. আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই
উত্তরঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই (২ বার)
৩. আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত দূত
উত্তরঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত দূত (২ বার)
৪. নামাজের জন্য এসো
উত্তরঃ আল্লাহর আশ্রয় ও শক্তি ছাড়া আর কারো কোন ক্ষমতা নাই (২ বার)
৫. সাফল্যের জন্য এসো
উত্তরঃ আল্লাহর আশ্রয় ও শক্তি ছাড়া আর কারো কোন ক্ষমতা নাই (২ বার)
৬. ঘুম হতে নামাজ উত্তম
উত্তরঃ সত্য বলেছেন, কল্যানের কথা বলেছেন (২ বার) (শুধুমাত্র ফযরের আযানের জন্য)
৭. আল্লাহ্ মহান
উত্তরঃ আল্লাহ্ মহান (২ বার)
৮. আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই
উত্তরঃ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই (১ বার)
উৎসঃ
- (সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নাম্বারঃ ৭০৬)
- (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নাম্বারঃ ৪৯৯)
ফজরের আযানের জবাব দেওয়ার নিয়ম?
ফজরের আযানে মুয়াজ্জিন সাধারণত দুইবার বলেনঃ “আস-সালাতু খাইরুম মিনান্ নাউম” (নামাজ ঘুমের চেয়ে উত্তম)
এর জবাবে শ্রোতা বলবেঃ “সাদাকতা ওয়াবাররতা। (সত্য বলেছেন, কল্যানের কথা বলেছেন)
আরও পড়ুনঃ তাশাহুদ আরবি ও বাংলা অর্থ
আযানের জবাব দেওয়া ও আজানের পর দোয়া পড়ার ফজিলত?
আযানের জবাব দেওয়া এবং আজানের পর দোয়া পড়ার ফজিলত অত্যাধিক। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি আজানের পর দোয়া পড়বে, সে কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ পাওয়ার অধিকারী হবে।”
(সহিহ বুখারি, মিশকাত)
আযানের পর দোয়া ও মুনাজাত মূলত নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দরুদ ও প্রশংসা। এই দরুদ পাঠ ও প্রশংসার মাধ্যমে একজন মুমিন ব্যক্তি পরকালে নবিজির সুপারিশ লাভ করবে, যা ইসলামে অত্যন্ত বড় পুরস্কার। নিচে হাদিসের আলোকে এর কিছু ফজিলত তুলে ধরা হলোঃ
১. কিয়ামতের দিন নবিজির সুপারিশ পাওয়ার সুযোগ
হজরত জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেনঃরাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আজান শুনে নিচের দোয়া পড়বে, সে কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ পাওয়ার অধিকারী হবে।”
দোয়াঃ
আরবিঃ
اللَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ وَالصَّلَاةِ الْقَائِمَةِ آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيلَةَ وَالْفَضِيلَةَ وَابْعَثْهُ مَقَامًا مَحْمُودًا الَّذِي وَعَدْتَهُ
উচ্চারণঃ
আল্লাহুম্মা রাব্বা হাজিহিদ্ দাওয়াতিত তাম্মাতি ওয়াছ ছালাতিল ক্বায়িমাহ, আতি মুহাম্মাদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদিলাহ, ওয়াবাআছহু মাক্বামাম মাহমুদানিল্লাজি ওয়া আত্তাহ।
ইংরেজি উচ্চারণঃ
Allāhumma rabba hādhihi-d-da‘watit-tāmmati waṣ-ṣalāti-l-qā’imati āti Muḥammadan al-wasīlata wa-l-faḍīlata wab‘ath-hu maqāman maḥmūdan alladhī wa‘adtah
বাংলা অর্থঃ
“হে আল্লাহ! এই পরিপূর্ণ আহ্বান ও আসন্ন সালাতের তুমি মালিক। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ওয়াসিলা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করুন। এবং তাঁকে সেই প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করুন, যার ওয়াদা তুমি করেছ।” (সহিহ বুখারি, মিশকাত)
২. গুনাহ মাফের সুযোগ
হজরত সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাছ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি মুয়াজ্জিনের আজান শুনে নিম্নের দোয়া পড়বে, তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।”
দোয়াঃ
আরবিঃ
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا
উচ্চারণঃ
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহ, ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু। রাদিতু বিল্লাহি রাব্বাও ওয়া বিমুহাম্মাদির রাসুলাও ওয়া বিল ইসলামি দ্বীনা।
বাংলা অর্থঃ
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি আল্লাহকে প্রভু হিসেবে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রাসূল হিসেবে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে খুশি হয়েছি।” (সহিহ মুসলিম, মিশকাত)
আযানের কিছু প্রচলিত ভুল ও সঠিক নির্দেশনা?
আযানের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ভুল প্রচলিত আছে, যেগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। নিচে কয়েকটি সাধারণ ভুল এবং সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা হলোঃ
১. “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ” শুনে দরুদ পাঠ করা
অনেকেই আযানের মধ্যে মুয়াজ্জিন যখন “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ” বলেন, তখন তারা “সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” বলেন।
সঠিক পদ্ধতিঃ
এটি অনুচিত নয়, কেননা এ সময় দরুদ পড়ার নির্দেশ নেই। বরং মুয়াজ্জিন যা বলেন, সেটাই বলা সুন্নত। তাই এখানে “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ”-ই বলতে হবে। দরুদ পাঠ করা হবে আজান শেষ হওয়ার পর।
প্রমাণঃ
(আল-বাহরুর রায়েক : ১/২৭৩)
(আহসানুল ফাতাওয়া : ২/২৭৮)
২. বৃদ্ধাঙ্গুলে চুমু খেয়ে চোখে মুছা
আমাদের সমাজে অনেকেই আযানের সময় “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ” শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলে চুমু খেয়ে চোখে মুছে থাকেন এবং অনেকে এর সঙ্গে “কুররাতু আইনি“এই দোয়াও পড়েন।
সঠিক পদ্ধতিঃ
এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং শরিয়তে এর কোনো প্রমাণ নেই। তাই এই কাজ করা বর্জনীয়।
প্রমাণঃ
(আল-মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা: ৬০৬)
(ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৫/২৫৯)
৩. আজানের সময় কথা বললে বেঈমান হয়ে যাওয়ার ভ্রান্ত বিশ্বাস
অনেকে মনে করেন, “আজানের জবাব না দিলে বা আজানের সময় কথা বললে বেঈমান হয়ে যায়, কিংবা বেঈমান অবস্থায় মারা যাওয়ার ভয় আছে” এমন কোনো কথা ইসলামে আছে।
সঠিক পদ্ধতিঃ
এ ধারণা ভুল ও ভিত্তিহীন। আজানের সময় জবাব দেওয়া সুন্নত, তবে এটি না দিলে বা আজানের সময় কথা বললে ঈমান চলে যাবে এমন কোনো হাদিস নেই।
প্রমাণঃ
(ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ৫/৪৩০)
কিছু কথাঃ
- আজানের জবাব দিতে হবে মুয়াজ্জিনের অনুসরণ করে।
- দরুদ পড়তে হবে আজান শেষ হওয়ার পর।
- বৃদ্ধাঙ্গুলে চুমু খাওয়া ও চোখে মুছা বিদআত, এটি বর্জন করতে হবে।
- আজানের সময় কথা বললে বেঈমান হয়ে যায় এ ধারণা ভুল।
আসুন, আমরা শুদ্ধ নিয়ম মেনে চলি এবং ভুল প্রথাগুলো বর্জন করি।
আরও পড়ুনঃ দোয়া কুনুত আরবি ও বাংলা
আযানের জবাব দেওয়ার নিয়ম?
আযানের জবাব দেওয়া প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তোমরা আযান শুনলে মুয়াযযিন যা বলে, তুমিও তা-ই বলো।” (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬১১)
আযানের প্রতি বাক্যের জবাবঃ
১. মুয়াযযিন বলেনঃ “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”
শ্রোতা বলবেন: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”
২. মুয়াযযিন বলেনঃ “আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”
শ্রোতা বলবেনঃ “আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”
৩. মুয়াযযিন বলেনঃ “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ”
শ্রোতা বলবেনঃ “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ”
(সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬১২)
৪. মুয়াযযিন বলেনঃ “হাইয়া ‘আলাস সালাহ” (নামাজের দিকে আসুন)
শ্রোতা বলবেনঃ”হাইয়া ‘আলাস সালাহ” অথবা
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই)
(সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬১৩)
৫. মুয়াযযিন বলেনঃ “হাইয়া ‘আলাল ফালাহ” (সফলতার দিকে আসুন)
শ্রোতা বলবেনঃ
“হাইয়া ‘আলাল ফালাহ” অথবা
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”
(সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৬৮৫)
৬. মুয়াযযিন বলেনঃ “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”
শ্রোতা বলবেনঃ “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”
৭. মুয়াযযিন বলেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”
শ্রোতা বলবেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”
বিঃদ্রঃ
এভাবে আযানের জবাব দিলে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুপারিশ লাভ করা যাবে।
শেষ কথা
- আজানের সময় মুয়াজ্জিনের অনুসরণ করে জবাব দেওয়া সুন্নত।
- আজানের পর দরুদ শরিফ পাঠ করা ও দোয়া করা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ।
- উল্লিখিত দোয়াগুলো পড়লে কিয়ামতের দিন নবিজির সুপারিশ লাভ করা যাবে।
- এই আমল গুনাহ মাফের বড় সুযোগ এনে দেয়।
আসুন, আমরা নিয়ম অনুযায়ী আজানের জবাব দেই ও দোয়া পড়ে আল্লাহর রহমত লাভ করি।