ইসলাম

শবে কদরের আমল

শবে কদর ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা এই রাতকে এত মর্যাদা দিয়েছেন যে, এর ফজিলত সম্পর্কে কোরআনে আলাদা একটি সূরা (সূরা কদর) নাজিল করেছেন।শবে কদরের আমলএই রাতে বান্দার জন্য অগণিত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়। তাই এই রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।

শবে কদরের আমল?

নিচে শবে কদরের আমল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

১. গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করা

রমজানের শেষ দশকের যে কোনো রাত লাইলাতুল কদর হতে পারে। তাই বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে বেশি করে ইবাদত করা উচিত এবং আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করা জরুরি।

একবার হজরত আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলেনঃ

“হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমি জানতে পারি যে কোনো একটি রাত লাইলাতুল কদর, তাহলে আমি কোন দোয়া পড়বো?” তখন তিনি বললেন, এই দোয়াটি পড়বেঃ

> اللَّهمَّ إنَّك عفُوٌّ كريمٌ تُحِبُّ العفْوَ، فاعْفُ عنِّي

বাংলা উচ্চারণঃ

আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিম, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।

বাংলা অর্থঃ

হে আল্লাহ! আপনি পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করুন। (তিরমিজি: ৩৫১৩)।

২. এশা ও ফজর নামাজ জামাতে আদায় করা

শবে কদরের ফজিলত ও বরকত লাভের আশায় অনেকেই রাতভর নফল ইবাদত করেন। কিন্তু অনেকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যান, যা নফল ইবাদতের চেয়েও বেশি গুরুত্ব রাখে ফরজ নামাজ, বিশেষ করে জামাতে এশা ও ফজর আদায় করা।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ  “যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতে আদায় করে, সে যেন পুরো রাত নামাজে কাটাল।” (মুসলিম ৬৫৬)

এ কারণে শবে কদরে নফল ইবাদতের পাশাপাশি এশা ও ফজরের নামাজ যেন অবশ্যই জামাতে আদায় করা হয়, সে বিষয়ে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শবে কদরের প্রকৃত মর্যাদা বোঝার এবং যথাযথভাবে ইবাদত করার তাওফিক দান করুন।

৩. ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকা

লাইলাতুল কদর এক মহান ও বরকতময় রাত, যা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। তবে এই রাতের সঠিক দিন নির্দিষ্টভাবে জানানো হয়নি এবং এর অন্যতম কারণ ছিল মানুষের ঝগড়া-বিবাদ।

একটি হাদিসে হজরত উবাদা ইবনে সামিত (রা.) বর্ণনা করেছেনঃ

“রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানাতে আসছিলেন, কিন্তু দুই ব্যক্তি ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়ায় সেই জ্ঞান উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে এটি রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে।” (সহিহ বুখারি ৪৯)।

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ঝগড়া-বিবাদ শুধু মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কই নষ্ট করে না। বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত করতে পারে।

৪. রাত জেগে ইবাদত করা

লাইলাতুল কদর এমন একটি রাত, যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও বেশি। এই পবিত্র রাতে ইবাদত করলে অসংখ্য সওয়াব অর্জন করা যায় এবং অতীতের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ  “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।” (সহিহ বুখারি ২০১৪, সহিহ মুসলিম ৭৬০)

এই কারণে মুমিনদের উচিত শবে কদরের এই বরকতময় রাতকে যথাযথভাবে ইবাদতে কাটানো নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই মহিমান্বিত রাতের ফজিলত অর্জনের তাওফিক দান করুন।

৫. নফল নামাজ আদায় করা

সালাতুত তাসবিহ

পাপমোচনের জন্য উত্তম নামাজ

নফল তাহাজ্জুদ

  • আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত
  • দুই রাকাত নফল নামাজ বারবার পড়া

৬. কোরআন তিলাওয়াত করা

  • এই রাতে কোরআন তিলাওয়াত করা অত্যন্ত বরকতময়।
  • সূরা কদর, সূরা ইয়াসিন, সূরা আল-ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস বেশি করে পড়া যেতে পারে।

৭. সালাতুত তাসবিহের নামাজ আদায় করা

সালাতুত তাসবিহ এক বিশেষ নফল নামাজ, যা পাপ মোচনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এতে এমন এক বিশেষ তাসবিহ পাঠ করা হয়, যা আল্লাহর প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ।

তাসবিহঃ

> سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ للهِ، وَلَا إلَهَ إلّا اللهُ، وَاللهُ أكْبَر

বাংলা উচ্চারণঃ

সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।

বাংলা অর্থঃ

মহাপবিত্র আল্লাহ, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।

সালাতুত তাসবিহের গুরুত্ব?

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিতঃ

> রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার চাচাকে এই নামাজ শিক্ষা দিয়ে বলেনঃ “চাচা! যদি পারো, তবে প্রতিদিন একবার এই নামাজ পড়ো।

যদি তা সম্ভব না হয়, তবে সপ্তাহে একবার, মাসে একবার, বছরে একবার কিংবা জীবনে অন্তত একবার হলেও পড়ো।” (ইবনে মাজাহ ১৭৩, বুখারি ৩৪২৩)।

সালাতুত তাসবিহ নামাজের নিয়ম?

  • চার রাকাত (এক সালামে বা দুই সালামে আদায় করা যায়)।
  • নিয়তঃ স্বাভাবিকভাবে “আমি চার রাকাত নফল সালাতুত তাসবিহ পড়ছি” বলে নিয়ত করতে হবে।

তাসবিহ পাঠের নিয়ম?

  • প্রতি রাকাতে ৭৫ বার তাসবিহ পাঠ করতে হবে।
  • সানা (সুবহানাকাল্লাহুম্মা) পড়ার পর → ১৫ বার তাসবিহ
  • সুরা ফাতিহা ও অন্য সুরার পর → ১০ বার তাসবিহ
  • রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবিহের পর → ১০ বার তাসবিহ
  • রুকু থেকে দাঁড়িয়ে ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ বলার পর → ১০ বার তাসবিহ
  • প্রথম সিজদার তাসবিহের পর → ১০ বার তাসবিহ
  • সিজদার মাঝখানে বসে → ১০ বার তাসবিহ
  • দ্বিতীয় সিজদার তাসবিহের পর → ১০ বার তাসবিহ

এইভাবে চার রাকাতে মোট ৩০০ বার তাসবিহ পাঠ করতে হবে।

বিশেষ নির্দেশনাঃ

কোনো রাকাতে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে কম তাসবিহ পড়া হলে, পরবর্তী রুকনে তা পূরণ করে নিতে হবে।

ফজিলত ও উপকারিতা?

➡ আগের ও পরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। (আবু দাউদ ১২৯৭, ইবনে মাজাহ ১৩৮৭)
➡ জীবনে অন্তত একবার আদায় করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। (বুখারি ৩৪২৩)
➡ এটি আত্মশুদ্ধির উত্তম মাধ্যম।

মোট কথা শবে কদরের মতো বরকতময় রাতে সালাতুত তাসবিহ আদায় করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এ নামাজ মুমিনের জন্য পাপ মোচন ও নৈকট্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button